আলুর উৎপাদন প্রযুক্তি
মাটি
আলু চাষের জন্য বেলে দোআাঁশ ও দোআাঁশ ধরনের মাটি সবচেয়েদ উপযোগী।
বপনের সময়
উত্তরাঞ্চলে মধ্যে-কার্তিক (নভেম্বর প্রথম সপ্তাহ), দক্ষিণাঞ্চলে অগ্রহায়ণ ১ম সপ্তাহ থেকে ২য় সপ্তাহ (নভেম্বর মধ্য থেকে শেষ সপ্তাহ।)
বীজের হার
প্রতি হেক্টর ১.৫ টন।
রোপণের দূরত্ব ৬০*১৫ সেমি (কাটা আলু)
সারের পরিমাণ
আলু চাষে নিচে উল্লেখিত হারে সার ব্যবহার করা প্রয়োজন।
সারের নাম |
সারের পরিমাণ/হেক্টর |
ইউরিয়া |
২২০-২৫০ কেজি |
টিএসপি |
১২০-১৫০ কেজি |
এমপি |
২২০-২৫০কেজি |
জিপসাম |
১০০-১২০ কেজি |
জিংক সালফেট |
৮-১০ কেজি |
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট (অমস্নীয় বেলে মাটির জন্য) |
৮০-১০০ কেজি |
বোরন (বেলে মাটির জন্য) |
৮-১০ কেজি। |
গোবর |
৮-১০ টন। |
সার প্রয়োগ পদ্ধতি
গোবর, অর্ধেক ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি, জিপসাম ও জিংক সালফেট (প্রয়োজনবোধে) রোপনের সময় জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর অর্থাৎ দ্বিতীয় বার মাটি তোলার সময় প্রয়োগ করতে হবে। অম্লীয় বেলে মাটির জন্য ৮০-১০০ কেজি/হেক্টর ম্যাগনেসিয়াম সালফেট এবং বেলে মাটির জন্য বোরন ৮-১০ কেজি/হেক্টর প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
পানি সেচ
বীজ আলু বপনের ২০-২৫ দিনের মধ্যে (ষ্টোলন বের হওয়ার সময়) প্রথম সেচ দিতে হবে, দ্বিতীয় সেচ বীজ আলু বপনের ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে (শুটি বের হওয়া পর্যন্ত) এবং তৃতীয় সেচ আলুর বীজ বপনের ৬০-৬৫ দিনের মধ্যে (শুটির বৃদ্ধি পায়) দিতে হবে। দেশের উত্তরাঞ্চলে বেশি ফলন পেতে হলে ৮-১০ দিন পর সেচ দিতে হবে।
অমত্মর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
আলু লাগানোর ৩০-৩৫ দিন পর গোড়ায় মাটি দেওয়া প্রয়োজন।
দেশী আলুর উন্নয়ন কৌশল
অতীতে বিদেশে থেকে তযে সকল আলুর জাত এদেশে এসেছে তা কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে এখনও চাষাবাদে আছে। এ সকল জাতই বর্তমানে দেশী জাত হিসেবে পরিচিত।
দেশে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে দেশী জাতের আলুর চাষ হয় যা মোট আলু জমির প্রায় ৩২%। দেশী আলু, জাতীয় মোট উৎপাদনে প্রায় শতকরা ২২ ভাগ অবদান রাখে। আধুনিক জাত অপেক্ষা ফলন কম হেক্টরপ্রতি গড়ে ৭.৮ টন) হওয়া সত্যেও প্রধানত স্বাদ এবং সংরক্ষণ গুণাগুণের জন্য দেশী জাত আমাদের দেশে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে খুবই সমাদৃত।
দেশী জাতের আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে দেশে সামগ্রিক আলুর উৎপাদন বেড়ে যাবে। উন্নত উৎপাদন কৌশল অবলম্বন করে দেশী আলুর নির্বাচিত জাত থেকে হেক্টরপ্রতি ২০-২৫ টন ফলন পাওয়া যেতে পারে।
উৎপাদন পদ্ধতি
আলুর জাতঃ লাল পাকড়ি, লাল শীল, চলিস্নশা, শিল বিলাতী, দোহাজারী ইত্যাদি।
নিরোগ গাছ থেকে মাঝারি আকারের বীজ সংগ্রহ করে হিমাগারে সংরক্ষণ করতে হবে।
নির্বাচন করে উপযুক্ত জমি ভালভাবে চাষ দিয়ে আলু লাগাতে হবে।
বপনের সময়
কার্তিক মাসে (মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বর ) আলু লাগানোর উপযুক্ত সময়।
বীজের হার
হেক্টরপ্রতি (মাঝারি আকারের আলু) ১ টন।
বপন পদ্ধতি
সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সেমি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২০ সেমি রাখতে হবে। ৪-৫ সেমি মাটির গভীরে বীজ বপন করে ভেলী তৈরি করতে হবে।
সারের পরিমাণ
হেক্টরপ্রতি নিম্নরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম |
সারের পরিমাণ/হেক্টর |
ইউরিয়া |
২২০-২৫০কেজি |
টিএসপি |
১৩০-১৫০ কেজি |
এমপি |
২৩০-২৫০ কেজি |
জিপসাম |
১১০-১৩০ কেজি |
জিংক সালফেট |
১২-১৬ কেজি |
বরিক এসিড |
৫-৭ কেজি |
সার প্রয়োগ পদ্ধতি
বপনের সময় অর্ধেক ইউরিয়া জমিতে প্রয়োগ করে পরবর্তীতে বাকি অর্ধেক উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বপনের ৪০-৪৫ দিন পর বাকি অর্ধেক ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করে ভেলীতে মাটি উঠিয়ে জমিতে সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনে ৩-৪ বার সেচ দিতে হবে। উইরিয়া এবং এমপি সার উপরি প্রয়োগের পর সেচ দিয়ে কচুরীপানা অথবা খড়কুটা দিয়ে মালচ করে দিতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা
আলুর মড়ক বা নাবী ধ্বসা (লেইট বস্নাইট) রোগ দমন
ফাইটপথোরা ইনফেসটেনস নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। প্রথমে পাতা, ডগা ও কান্ডে ছোট দাগ পড়ে। ক্রমে দাগ বড় হয় ও সমগ্র পাতা, ডগা ও কান্ডের কিছু অংশ ঘিরে ফেলে। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি থাকলে ২-৩ দিনের মধ্যেই জমির অধিকাংশ ফসল আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ভোরের দিকে আক্রান্ত পাতার নিচে সাদা পাউডারের মত ছত্রাক চোখে পড়ে। আক্রান্ত ক্ষেতে পোড়া পোড়া গন্ধ পাওয়া যায়। এবং মনে হয় যেন জমির ফসল পুড়ে গেছে।
প্রতিাকর
আলুর আগাম ধ্বসা বা আর্লি বস্নাইট রোগ দমন
অলটারনারিয়া সোলানাই নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। নিচের পাতা ছোট ছোট বাদামি রংয়ের অল্প বসে-যাওয়া কৌণিক দাগ পড়ে। আক্রামত্ম অংশে সামান্য বাদামি এলাকার সাথে পর্যায়ক্রমে কালচে রংয়ের চক্রাকার দাগ অপেক্ষাকৃত লম্বা ধরনের হয়। গাছ হলদে হওয়া, পাতা ঝরে পড়া এবং অকালে গাছ মরে যাওয়া এ রোগের লক্ষণীয় উপসর্গ। আক্রান্ত টিউবারের গায়ে গাঢ় বাদামি থেকে কালচে বসে যাওয়া দাগ পড়ে।
প্রতিকার
কান্ড ও আলু পচা রোগ
স্কেলেরোসিয়াম রলফসি নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগের আক্রমণের ফলে বাদামি দাগ কান্ডের গোড়া ছেয়ে ফেলে। গাছ ঢলে পড়ে এবং পাতা বিশেষ করে নিচের পাতা হলদে হয়ে যায়। আক্রান্ত অংশে বা আশেপাশের মাটিতে ছত্রাকের সাদা জালিকা দেখা যায়। কিছু দিন পর সরিষার দানার মত রোগ জীবাণুর গুটি বা স্কেলেরোসিয়া সৃষ্টি হয়। আলুর গা থেকে পানি বের হয় এবং পচন ধরে। ক্রমে আলু পচে নষ্ট হয়ে যায়।
প্রতিকার
আলুর স্টেম ক্যাঙ্কার স্কার্ফ রোগ দমন
রাইজকটোনিয়অ সোলানাই নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। গজানো অঙ্কুরের মাথায় এবং ষ্টোলনে আক্রমণের দাগ দেখা যায়। বড় গাছের গোড়ার দিকে লম্বা লালচে বর্ণের দাগ বা ক্ষতের সৃষ্টি হয় । কান্ডের সাথে ছোট ছোট টিউবার দেখা যায়। আক্রামত্ম টিউবারের গায়ে শক্ক কালচে সুপ্ত রোগ জীবাণুর গুটি দেখা যায়।
প্রতিকার
ঢলে পড়া এবং বাদামি পচন রোগ দমন
সিউডোমোনাস সোলানেসিয়ারাম নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। গাছের একটি শাখা বা এক অংশ ঢলে পড়তে পারে। পাতা সাধারণত হলুদ হয় না। এবং সবুজ অবস্থায়ই চুপসে ঢলে পড়ে। গোড়ার দিকে গাছের কান্ড ফেড়ে দেখলে বাদামি আক্রামত্ম এলাকা দেখা যায়। ঢলে পড়া গাছ খুব দ্রুত চুপসে যায়। আক্রান্ত আলু কাটলে ভিতরে বাদামি দাগ দেখা যায়। আলুর চোখে সাদা পুঁজের মত দেখা যায় এবং আলু অল্প দিনের মধ্যেই পচে যায়।
প্রতিকার
আলুর দাদ রোগ
স্ট্রেপ্টোমাইসিস স্কেবিজ নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। হালকা দাদ হলে টিউবারের উপরে উঁচু এবং ভাসা বিভিন্ন আকারের বাদামী দাগ পড়ে। রোগের গভীর দাদে গোলাকার গর্ত বা ডাবা দাগ পড়ে। রোগের আক্রমণ সাধারণত ত্বকেই সীমাবদ্ধ থাকে।
প্রতিকার
আলুর পাতা মোড়ানো রোগ দমন
এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। আক্রামত্ম পাতা খসখসে, খাড়া ও উপরের দিক মুড়ে যায়। আগার পাতার রং হালকা সবুজ হয়ে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। কখনো আক্রান্ত পাতার কিনারা লালচে বেগুনি রংয়ের হয়। গাছ খাটো হয় এবং সোজা হয়ে উপরের দিকে দাঁড়িয়ে থাকে। আলুর সংখ্যা কমে যায় এবং আলু অনেক ছোট হয়।
প্রতিকার
আলুর মোজাইক রোগ দমন
পাতায় বিভিন্ন ধরনের ছিটে দাগ পড়ে, পাতা বিকৃত ও ছোট হয়। ভাইরাস এবং আলুর জাতের উপর নির্ভর করে লক্ষণ ভিন্নতর হয়। লতা ঝুলে পড়ে এবং পরবর্তীতে গাছ মারা যায়।
প্রতিকার
আলুর হলদে রোগ দমন
স্থানীয় জাতের আলুতে এ রোগ বেশি হয়। পাতা কুঁচকে যায় ও ছিটা দাগ দেখা যায়। দূর থেকে আক্রান্ত গাছ সহজেই চোখে পড়ে। আলু ছোট হয় বা একেবারেই হয় না।
প্রতিকার
আলুর শুকনো পচা রোগ দমন
ফিউজেরিয়াম প্রজাতির ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। আলুর গায়ে কিছুটা গভীর কালো দাগ পড়ে। আলুর ভিতরে গর্ত হয়ে যায়। প্রথম পচন যদিও ভিজা থাকে পরে তা শুকিয়ে শক্ক হয়ে যায়। আক্রান্ত অংশে গোলাকার ভাঁজ এবং কখনো কখনো ঘোলাটে সাদা ছত্রাক জালিকা দেখা যায়।
প্রতিকার
আলুর নরম পচা রোগ দমন
আরউইনা কেরোটোফেরারা ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত অংশের কোষ পচে যায়। পচা আলুতে এক ধরণের উগ্র গন্ধের সৃষ্টি হয়। চাপ দিলে আলু থেকে এক প্রকার দূষিত পানি বেরিয়ে আসে। আক্রান্ত অংশ ঘিয়ে রংয়ের ও নরম হয় যা সহজেই সুস্থ অংশ থেকে আলাদা করা যায়।
প্রতিকার
আলুর কাটুই পোকা
কাটুই পোকার কীড়া বেশ শক্তিশালী, ৪০-৫০ মিমি লম্বা। পোকাড় উপর পিঠ কালচে বাদামি বর্ণের, পার্শ্বদেশ কালো রেখাযুক্ত এবং বর্ণ ধূসর সবুজ। শরীর নরম ও তৈলাক্ত। কাটুই পোকার কীড়া চারা গাছ কেটে দেয় এবং আলুতে ছিদ্র করে আলু ফসলের ক্ষতি করে থাকে।
পোকার কীড়া দিনের বেলা মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে। আলুর কাটা গাছ অনেক সময় কাটা গোড়ার পাশেই পড়ে থাকতে দেখা যায়।
প্রতিকার
আলুর সুতলী পোকা
আলুর সুতলী পোকার মথ আকারে ছোট, ঝালরযুক্ত, সরম্ন ডানা বিশিষ্ট ধূসর বাদামি হয়। পূর্ণাঙ্গ কীড়া সাদাটে বা হাল্কা গোলাপী বর্ণের এবং ১৫-২০ মিমি লম্বা হয়ে থাকে। কীড়া আলুর মধ্যে লম্বা সুড়ঙ্গ করে আলুর ক্ষতি করে থাকে। বাংলাদেশে বসতবাড়িতে সংরক্ষিত আলু এ পোকার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
প্রতিকার
অন্যান্য প্রযুক্তি
টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে বীজ আলু উৎপাদন
আলু বীজের প্রধানত ভাইরাস রোগের মাত্রার উপর নির্ভর করে। ভাইরাস রোগ বংশ পরম্পরায় ১০ গুণ হারে বৃদ্ধি পায়। টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ ভাইরাস রোগমুক্ত গাছ উৎপাদন করা যায়।
গবেষণাগারে উৎপন্ন টেস্ট টিউবের গাছ বা মাইক্রোটিউবার নেট হাউজের ভিতর লাগিয়ে রোগমুক্ত আলু উৎপাদন করা হয়। আলু গাছের প্রতিটি পাতার ফাঁকে একটি কুঁড়ি থাকে। এ সকল কুঁড়ি (০.৪-০.০৫ মিমি) জীবাণুমুক্ত অবস্থায় কেটে কৃত্রিম পুষ্টিকর খাদ্য মাধ্যমে স্থাপন করে বিশেষ তাপমাত্রা (২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং আলোতে (ত কিলোলাক্স) রাখতে হয়। এ অবস্থায় কুঁড়ি থেকে ৪০-৫০ দিনে মধ্যে গাছ গাজাতে আরম্ভ করে। টেস্ট টিউবের ভিতর গাছ ৮-৯ পাতা বিশিষ্ট হলে প্রতিটি পর্বসন্ধি জীবাণুমুক্ত অবস্থায় কেটে পুষ্টিকর খাদ্য মাধ্যমে স্থাপন করে উলেস্নখিত পরিবেশে রাখলে ২০-২৫ দিনের মধ্যে প্রতিটি পর্বসন্ধি থেকে একটি ৫-৬ সেমি লম্বা গাছ পাওয়া যায়।
এরপর ভাইরাস মুক্ত গাছ দিয়ে পর্বসন্ধ কর্তন () করে সারাবছর গবেষণাগারে টেস্ট টিউবের ভিতর গাছ এবং মাইক্রোটিউবার উৎপন্ন করা যায়। গবেষণাগারের গাছ বা মাইক্রোটিউবার এবং এদের থেকে উৎপন্ন আলু কমপক্ষে ৩ বছর নেট হাউজের ভিতর লাগাতে হবে। টেস্ট টিউবের গাছ বা মাইক্রোটিউবার নেট হাউজের ভিতর লাগানোর পর এদের পরিচর্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সকল আলু আরও ২ বছর নেট হাউজে লাগাতে হবে এবং ৪ ও ৫ বছর মাঠে লাগিয়ে বেমি পরিমাণ বীজ আলু উৎপন্ন করতে হবে।
উন্নত মানের বীজে আলু উৎপন্ন করতে এটাই সহজ পদ্ধতি। গবেষণাগারে একটি গাছ বা একটি মাইক্রোটিউবার উৎপন্ন করতে খরচ হয় মাত্র ১০-২০ পয়সা। একটি টেস্টটিউবের গাছ থেকে জাতভেদে ৩০-৪০ টি আলু পাওয়া যায়। এ সকল আলুর ওজন মোটামুটি ১৫-২০ গ্রাম।
র্যাপিড মাল্টিপ্লিকেশণ পদ্ধতিতে আলু উৎপাদন
আলু উৎপাদনের র্যাপিড মাল্টিপ্লিকেশনের মধ্যে প্রধান হচ্ছে স্প্রাইট কাটিং এবং টপ শুট কাটিং। যা নিচে বর্ণনা করা হল।
স্প্রাইট কাটিং
বীজ আলু জমিতে লাগানোর ৪০-৪৫ দিন পূর্বে হিমাগার থেকে বের করে প্রথম ৩০ দিন অন্ধকারে এবং শেষের ১০-১৫ দিন ছায়াযুক্ত স্থানে রাখলে একটি ১০০ গ্রাম আকারের আলুতে ২-৫ সেমি লম্বা প্রায় ৪-৭ টি স্প্রাউট পাওয়া যাবে। এ সকল স্প্রাউট এর প্রতিটির গায়ে ৩-৫টি পর্বসন্ধি থাকে। সব স্প্রাউট ভেঙ্গে প্রতিটি কুঁড়ি কর্তন করে বালির বেড়ে লাগালে ৪-৭দিনের মধ্যে শিকড়সহ ৪-৭ সেমি লম্বা গাছ পাওয়া যাবে। এ সকল গাছ, এক চোখ বিশিষ্ট কাটা বীজ আলুর মত জমিতে লাগিয়ে কাটা বীজ আলুর মত ফলন পাওয়া যাবে।
টপ শুট কাটিং
টপ শুট কাটিং উৎপাদিন গাছ থেকে নিতে হয়। আলু লাগানোর ২০-২৫ দিন পরে ৩-৫ সেমি লম্বা করে মাথা কেটে নেওয়াকে টপ শুট কাটিং বলে। একই গাছ থেকে ১০-১২ দিন অমত্মর অমত্মর ৩-৪ বার এ-কাটিং নেওয়া যায়। এ সকল কাটিং ইনডোল বিউটারিক এডিড (২৫ পিপিএম) ও ন্যাপথালিন এসিটিক এসিড (১২.৫ পিপিএম) মিশ্রিত শিকড় উৎপাদনকারী (রম্নটিং) হরমোন দ্রবণে ডুবিয়ে নিতে হবে। কর্তিত মাথা ডুবিয়ে নিয়ে পরে শিকড় গজানোর জন্য বালির বেডে লাগাতে হবে। বালির বেড় থেকে ১০ দিনের মধ্যেই শিকড়সহ কাটিং জমিতে লাগাতে হবে। গাছ বাড়ার সাথে সাথে মাটি তুলে দিতে হবে। অন্যান্য পরিচর্যা স্বাভাবিক আলু গাছের মতই। এদের ফলন এক চোখ বিশিষ্ট কাটা আলুর মতই।
বিনা চাষে আলু উৎপাদন
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আলু চাষ মৌসুমের মেয়াদ কম থাকে। তদুপরি জমির উচ্চতা অনুসারে বর্ষার পানি সরে যেতে অনেক সময় লেগে যায়। সেসব জায়গায় দেরিতে আলু রোপণ করতে হয় বলে ফলন কম হয়। এ ধরণের নিচু জমিতে বিনা চাষে আলু উৎপানদ করা যায়।
রোপণের দূরত্ব ও পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে বীজ আলু সামান্য ঢেকে অথবা না ঢেকে মাটিতে ৬০ সেমি*২৫ সেমি দূরত্ব রোপণ করতে হবে। রোপণের পর আলুর সারি কচুরীাপানা অথবা খড় ১৭-২০ সেমি পুরম্ন করে ঢেকে দিতে হয়। এতে মাটিতে পর্যামত্ম রস থাকবে। এক্ষেত্রে কাটা আলু ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। এভাবে আলু উৎপাদনে তেমন পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। এ পদ্ধতিতে আলু সাধারণত মাটির উপরই উৎপন্ন হয়। এ পদ্ধতিতে কার্ডিনাল, ডায়ামন্ট প্রভৃতি উচ্চ ফলনশীল জাত ব্যবহার করতে হবে।
সারের পরিমাণ
বিনা চাষে আলু উৎপাদন জমিতে নিমণরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম |
সারের পরিমাণ/হেক্টর |
ইউরিয়া |
৩২০-৩৪০ কেজি |
টিএসপি |
১৯০-২২০ কেজি |
এমপি |
২০-৩০ কেজি |
সার প্রয়োগ পদ্ধতি
রোপণের পূর্বে সার প্রয়োগ করতে হবে। বীজ আলু রোপণ করে সারির উভয় পার্শ্বে লাইন টেনে তাতে সার ব্যবহার করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। প্রচলিত পদ্ধতিতে আস্ত ছোট ছোট বীজ আলু ব্যবহার করা উত্তম।
সতর্কতা
আলুর বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি
উন্নত মানের আলুর বীজ উৎপাদনের জন্য নিম্নরূপ পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়।
প্রকৃত বীজ দিয়ে আলু উৎপাদন
প্রকৃত বীজ দিয়ে আলু উৎপাদন বাংলাদেশের একটি নতুন প্রযুক্তি। ১৯৮০ সাল থেকে গবেষণা করে আলুা গাছের ফুল, ফল ও বীজের মাধ্যমে আলু উৎপাদনের এ পদ্ধতিকে বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপযোগী করে তোলা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে আলুর পরিবর্তে প্রকৃত বীজ ঘন কর লাগিয়ে অল্প জায়গা থেকে অনেক ছোট আল উৎপাদন করা হয় যা পরবর্তী বৎসর বীজ আলু হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বীজ আলু যেখানে হেক্টরপ্রতি ২ টন দরকার, সেখানে ৫০ গ্রাম প্রকৃত বীজের উৎপাদিত আরম্ন দিয়ে দ্বিতীয় বৎসর সেই পরিমাণ জমি আবাদ করা সম্ভব। আর রোপণ পদ্ধতিতে গেলে ১০০ গ্রাম। বীজের চারা দিয়ে এক হেক্টর রোপণ করা যায়।
প্রকৃত বীজ লাগানোর পূর্বে ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে নিতে হবে। মধ্য-কার্তিক (নভেম্বর) মাসে ১মি*১মি করে ৪টি বেড কুপিয়ে মাটি শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর বর্গমিটার প্রতি পচা শুকনা ১ ঝুড়ি গোবর বা মুরগির বিষ্ঠা, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমপি সার মাটিতে মিশিয়ে ভাল করে মিশিয়ে দিতে হবে। তারপর ২৫ সেমি দূরত্বে লাইন করে ৪ সেমি অমত্মর২-৩ টি বীজ বপন করতে হবে। বীজের উপরে গোবর মিশানো মাটি হালকা করে হাতের তালু দিয়ে একটু চেপে দিতে হবে যাতে পানি দেওয়ার সময় বীজ ভেসে না যায়। এর পরে ঝাজরা দিয়ে মাটি সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিতে হবে। উপরের মাটি যাতে শুকিয়ে না যায় তার জন্য সময় মত পানি দিতে হবে এবং বীজ গজানো পর্যমত্ম শুকনা নারিকেল বা সুপারী পাতা বা চাটাই দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
বীজ গজানোর এক সপ্তাহ পরে প্রতি গর্তে ২টি করে চারা রেখে বাকিগুলো অন্যত্র লাগানো যেতে পারে। দুই সপ্তাহ পরে ১টি করে চারা রেকে বাকিটা তুলে ফেলতে হবে। এক মাস পরে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে, সাথে কিছু ইউরিয়আ দিতে হবে। গাছের ৪০-৪৫ দিন বয়সে ইউরিয়াসহ আর একবার মাটি দিতে হবে। এরপরে সময়মত পানি এবং ১০ দিন অমত্মর কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
১০০ থেকে ১২০ দিনের মাথায় আলু উত্তোলন করা হয়। তবে রোপণ পদ্ধতিতে চারা রোপণের ৯০ দিনের মধ্যেই আলু তোলা যায়। বীঝ আলু উৎপাদন পদ্ধতিতে প্রকৃত বীজ লাগিয়ে বর্গমিটার প্রতি ৫ থেকে ৭ কেজি ছোট আলু পাওয়া যায়। এক কেজিতে গড়ে ১০০ টি ছোট আলু থাকে। এ আলু দ্বিতীয় বৎসর সাধারণ আলুর মত ৬০*২০ সেতি দূরত্ব লাগিয়ে হেক্টরপ্রতি ২৫-৩০ টন খাবার পাওয়া যায়। রোপণ পদ্ধতিতে প্রথম বৎসর ২০-২৫ টন খাবার আলু পাওয়া যায় কিছু অংশ বীজ আলু হিসেবে পরের বৎসর ব্যবহার করা যায়।
আলুর প্রকৃত বীজ (হাইব্রিড টিপিএস) উৎপাদন পদ্ধতি
বাংলাদেশে আলুর সংকর বীজ উৎপাদন একটি নতুন প্রযুক্তি। ১৯৮৫ সাল থেকে গবেষণা করে এ প্রযুক্তি বাংলাদেশের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। কৃত্রিম পদ্ধতিতে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দুই জাতের আলুর সংকরায়ণ করে এ বীজ উৎপাদন করা হয়। সংকর বীজের ক্ষমতা সাধারণ বীজ থেকে বেশি হওয়ায় এ বীজের চাহিদা বেশি।
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আলুর ফুল ও ফল উৎপাদনের জন্য দিনের দৈর্ঘ্য অমত্মত ১৬ ঘন্টার প্রয়োজন। তাই হাই প্রেশার সোডিয়াম লাইট ব্যবহার করতে হয়। ২৫০ ওয়াটের ৮টি ভাল্ব ৫মিটার উওপর থেকে ঝুলিয়ে দিয়ে ১৬০০ বর্গ মিটার জমিতে আলুর ফুল ও ফল উৎপাদন করা যায়। আলু লাগানোর ১৫ দিন পর থেকে বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যমত্ম আলো দিতে হবে।
আলু লাগানোর জন্য৫০ সেমি অমত্মর এক মিটার চওড়া বেডে ৫০ সেমি দূরত্ব ২ সারিতে ২০ সেমি অমত্মর আলু রোপণ করতে হবে। প্রতি ১০০ বর্গমিটার জমির জন্য ২০০ কেজি স্ত্রী জাতের এবং ৫০ কেজি পুরম্নষ জাতের প্রয়োজন হয়। পুরম্নষ জাতের আলু ১৫ দিন পূর্বে লাগানো প্রয়োজন। গাছেল ৩৫-৪০ দিন বয়সে ফুল আসা শুরম্ন হয়। এ সময় পরম্নষ গাছের ফুল তুলে রেণু সংগ্রহ করে ডেসিকেটরে সিলিকা জেলসহ রেখে দিতে হবে। স্ত্রী গাছেল ফুল ফোটার আগের দিন ফুলের গর্ভকেশন রেণুর ভিতর ডুবিয়ে দিতে হবে। প্রতি ফুলে ২-৩ বার বিকালে, পরের দিন সকালে এবং বিকালে রেণু প্রয়োগ করতে হবে। পরাগায়ণের দেড় মাস পরে ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে শুকিয়ে ডেসিকেটরে রাখতে হবে।
সাধারণত বাংলাদেশের অনেক এলাকায়াই সংকর বীজ উৎপাদন করা যায়। তবে যেখানে শীত কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং বাতাসে আর্দ্রতা কিছুটা বেশি থাকে, সে স্থান উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়। তাই দেশের উত্তরাঞ্চলে নদীর পার্শ্ববর্তী স্থানে ভাল ফলন পাওয়া যেতে পারে। সাধারণত সংকর বীজের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি। তাছাড়া যেখানে ভাল বীজ সময় মত পাওয়া যায় না বা ভাল বীজ কৃষকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে, সেখানে প্রকৃত বীজ দিয়ে আলু উৎপাদন সম্ভব হবে। এতে বিদেশ থেকে বীজআলু আমদানি অনেকটা হ্রাস পাবে।
কৃষক পর্যায়ে আলু সংরক্ষণ
আলু সংরক্ষণের জন্য হিমাগার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান, তবুও আলু সংগ্রহের মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ আলু স্থানীয়ভাবে বাড়িতে সংরক্ষণ করতে হয়। সে কারণে সংরক্ষণকালীণ সময়ে কয়েকটি গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এতে আলু ৫ থেকে ৬ মাস ভালভাবে ঘরে সংরক্ষণ করা যাবে এবং ৩ থেকে ৪ মাস পর বিক্রি করে লাভবান হওয়া যায়। আলু ঘরে সংরক্ষণ করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।